একদম সহজেই শিখুন সার্কিট ব্রেকার কাকে বলে, সার্কিট ব্রেকার কত প্রকার ও কি কি বিস্তারিত।
সার্কিট ব্রেকার নিয়ে লেখা আজকের আর্টিকেল থেকে একজন পাঠক যেসব বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হবেন তা হলোঃ-
- সার্কিট ব্রেকার কাকে বলে?
- সার্কিট ব্রেকার কত প্রকার ও কি কি?
- সার্কিট ব্রেকার কেন ব্যবহার করা হয়?
- বৈদ্যুতিক সিস্টেমে সার্কিট ব্রেকার লাগানোর নিয়ম কি?
- তাছাড়া, রয়েছে সার্কিট ব্রেকার নিয়ে আরো খুঁটিনাটি প্রশ্নের উত্তর।
সার্কিট ব্রেকার কি বা সার্কিট ব্রেকার কাকে বলে।
সার্কিট ব্রেকার কাকে বলে তা নিম্নে একদম সহজ ভাষায় আপনাদের মাঝে উপস্থাপন করা হলোঃসার্কিট ব্রেকার হলো এমন একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোন বৈদ্যুতিক সার্কিটের কারেন্ট প্রবাহকে বাঁধা প্রদান করে, যখন ইহা তার মধ্যদিয়ে নির্ধারিত মানের চেয়ে অতিরিক্ত কারেন্ট বা শর্ট সার্কিট কারেন্ট সনাক্ত করে।
সার্কিট ব্রেকারের সুইচিং মেকানিজম স্বয়ংক্রিয়ও হতে পারে, আবার ম্যানুয়ালিও পরিচালিত হতে পারে। সার্কিট ব্রেকার সাধারণত বাসাবাড়ি এবং শিল্প কারাখানায় ওভারলোড বা শর্ট সার্কিট জনিত কারেন্ট দ্বারা সৃষ্ট বৈদ্যুতিক সার্কিট তথা বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য নিরাপত্তা প্রদানকারী যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
সার্কিট ব্রেকার কেন ব্যবহার করা হয় বা সার্কিট ব্রেকারের কাজ কি?
একটি ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটে সার্কিট ব্রেকার কেন ব্যবহার করা হয় তা নিম্নে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হলোঃবৈদ্যুতিক নিরাপত্তাঃ প্রাথমিকভাবে, সার্কিট ব্রেকার বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে ওভারলোড, শর্ট সার্কিট এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষতি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের জীবনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এমন দুর্ঘটনা থেকে নিরাপত্তা প্রদান করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসঃ একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে ফল্ট কারেন্ট প্রবাহের কারণে বৈদ্যতিক যন্ত্রপাতিকে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে সার্কিট ব্রেকার রক্ষা করে থাকে। ইহা পরবর্তীতে যন্ত্রপাতির মেরামত করা বা প্রতিস্থাপন করার পিছনে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় কমাতেও সাহায্য করে থাকে।
আগুন লাগার ঝুঁকি হ্রাসঃ ফল্ট কারেন্ট প্রবাহের কারণে একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে যা পরবর্তীতে শিল্প কারখানা বা বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত দাহ্য পদার্থের সাথে মিশে বড় ধরনের বিস্ফোরণও সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, সার্কিট ব্রেকার যখন কোন ধরনের অস্বাভাবিক কারেন্ট শনাক্ত করতে পারে, তখন সার্কিটের ত্রুটিপূর্ণ অংশ বা লোডকে সুস্থ অংশ থেকে আলাদা করে আগুন লাগার ঝুঁকি কমিয়ে থাকে।
পুনঃব্যবহার যোগ্যতাঃ ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য আরও অনেক যন্ত্র থাকলেও সার্কিটের ফল্ট অপসারণ করার পর সার্কিট ব্রেকারকে আবার পুনরায় আগের মত ব্যবহার করা যায়, অর্থাৎ সার্কিট ব্রেকার নতুন করে প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন নেই। সুতরাং, সার্কিট ব্রেকার একটি বৈদ্যুতিক সিস্টেমের জন্য সাশ্রয়ী এবং সুবিধাজনক নিরাপত্তা সেবা প্রদান করে থাকে।
অধিক নমনীয়তা প্রদানঃ যেখানে অসংখ্য বৈদ্যুতিক লোডে এবং বিভিন্ন ধরনের মেশিনারি ব্যবহার করা হয়, এমন বৈদ্যুতিক সিস্টেমকে চাহিদামত ডিজাইন এবং অপারেট করার অধিক নমনীয়তা প্রদান করার জন্য সার্কিট ব্রেকার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাছাড়া, একটি বৈদ্যুতিক সিস্টেমে সার্কিট ব্রেকার ইন্সটল করা, মেরামত করা এবং পরিচালনা করাও অনেক সহজ হয়ে থাকে।
সার্কিট ব্রেকার কত প্রকার ও কি কি?
একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটের কারেন্ট রেটিং, প্রয়োগকৃত ভোল্টেজ এবং পরিচালনা পদ্ধতির উপর নির্ভর করে সার্কিট ব্রেকার বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তবে, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় এমন সার্কিট ব্রেকার কত প্রকার ও কি কি তা নিম্নে তুলে ধরা হলোঃএয়ার সার্কিট ব্রেকারঃ এই ধরনের সার্কিট ব্রেকার একটি ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটকে বিচ্ছিন্ন করার সময় সৃষ্ট বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গকে নিভানোর জন্য সংকুচিত বায়ু ব্যবহার করে থাকে। ইহা সাধারণত উচ্চ-ভোল্টেজ সার্কিট, যেমন পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং সাবস্টেশনগুলিতে ব্যবহৃত হয়। বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ বা আর্ককে নিভানোর জন্য এয়ার বা বাতাস ব্যবহৃত হয় বলে ইহাকে এয়ার সার্কিট ব্রেকার বলা হয়।
ওয়েল সার্কিট ব্রেকারঃ এই ধরনের সার্কিট ব্রেকারগুলিতে ইনসুলেটর হিসাবে তেল ব্যবহার করা হয় এবং সাধারণত যেখানে উচ্চ ভোল্টেজের প্রয়োগ হয়ে থাকে সেখানে ইহা ব্যবহৃত হয়। ইহা খুব হাই কারেন্টে পরিচালনা করার জন্য এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষতি রোধ করতে খুব দ্রুত সার্কিটকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
ভ্যাকুয়াম সার্কিট ব্রেকারঃ এই ধরনের সার্কিট ব্রেকারগুলিতে ইনসুলেটর হিসাবে ভ্যাকুয়াম ব্যবহার করা হয়। ইহা সাধারণত সুইচগিয়ার এবং ট্রান্সফরমারের মতো মাঝারি ভোল্টেজের যেখানে প্রয়োগ রয়েছে সেখানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভ্যাকুয়াম সার্কিট ব্রেকারের ডিজাইন খুবই কমপ্যাক্ট হওয়ার কারণে এবং ইহার সুইচিং টাইম খুব দ্রুত হওয়ার কারণে শিল্প কারখানায় ইহা খুবই জনপ্রিয় একটি সার্কিট ব্রেকার।
এসএফসিক্স সার্কিট ব্রেকারঃ SF6 বা সালফার হেক্সাফ্লোরাইড সার্কিট ব্রেকার হলো একটি উচ্চ ভোল্টেজের সার্কিট ব্রেকার। এই ধরনের সার্কিট ব্রেকারে ইনসুলেটর হিসাবে এবং বৈদ্যুতিক আর্ক নিভানোর জন্য SF6 গ্যাস ব্যবহার করা হয়। SF6 একটি অত্যন্ত শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস, তবে এটির চমৎকার বৈদ্যুতিক আর্ক নিভানোর বৈশিষ্ট্যও রয়েছে।
আরো কিছু ব্যবহৃত সার্কিট ব্রেকার এর তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলোঃ
এমসিবি (MCB): MCB এর পূর্ণনাম হচ্ছে মিনিয়েচার সার্কিট ব্রেকার (Miniature Circuit Breaker), ইহা বাসাবাড়ি এবং ছোট বাণিজ্যিক ভবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি সার্কিট ব্রেকার। ইহা লো ভোল্টেজ সার্কিটে সাধারণত ১২৫ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট পর্যন্ত নিরাপত্তা প্রদান করার জন্য ডিজাইন করা হয়ে থাকে।
এমসিসিবি (MCCB): MCCB এর পূর্ণনাম হচ্ছে মোল্ডেড কেজ সার্কিট ব্রেকার (Molded Case Circuit Breaker), ইহা সাধারণত শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয় যার কারেন্ট বহন ক্ষমতা MCB এর চেয়ে বেশি। MCCB চাইলে AC এবং DC উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।
আরসিসিবি (RCCB): RCCB পূর্ণনাম হচ্ছে রেসিডুয়াল কারেন্ট সার্কিট ব্রেকার (Residual Current Circuit Breaker), ইহা সাধারণত বৈদ্যুতিক শক থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। ইহা খুবই ক্ষুদ্র গ্রাউন্ড ফল্ট কারেন্ট সনাক্ত করতে সক্ষম যার জন্য ইহা শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
প্রত্যেক প্রকার সার্কিট ব্রেকারের রয়েছে আলাদা বিশিষ্ট্য এবং প্রয়োগ। অতএব, সার্কিট ব্রেকার ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উপযুক্ত সাইজ এবং সঠিক প্রকার বাছাই করা জরুরী।
সার্কিট ব্রেকার লাগানোর নিয়মঃ
- সার্কিট ব্রেকার লাগানোর পূর্বে অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য মেইন সাপ্লাই অফ করে নিতে হবে।
- যে সার্কিট বা লোডের জন্য সার্কিট ব্রেকার লাগাতে হবে সেই সার্কিট বা লোডের কারেন্ট এর মান কত তা সবার পূর্বে হিসাব করতে হবে।
- হিসাব করার পর কারেন্টের যে মান পাওয়া যাবে সেই কারেন্টের সাথে ১.২ গুন করতে হবে যদি লোড রেজিস্টিভ হয়ে থাকে।
- একইভাবে হিসাবকৃত কারেন্টের সাথে ০৩ থেকে ০৬ গুন কারেন্ট অতিরিক্ত ধরতে হবে যদি লোড ইন্ডাক্টিভ হয় এবং হিসাবকৃত কারেন্টের সাথে ০৬ গুন করতে হবে যদি লোড ক্যাপাসিটিভ হয়।
- এখানে মনে রাখা উচিত যে, হিসাবকৃত কারেন্টের মান যদি খুব বেশি হয়, অর্থাৎ লোডের কারেন্ট বেশি হলে, যেমন, পানির পাম্প, এয়ার কন্ডিশন, হিটার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রতিটি লোডের জন্য আলাদা আলদা সার্কিট ব্রেকার লাগানো উত্তম।
- চূড়ান্তভাবে হিসাবকৃত কারেন্টের মান দ্বারা নির্ধারণ করতে হবে কত অ্যাম্পিয়ারের সার্কিট ব্রেকার লোডের সাথে সংযোগ করতে হবে। তবে, অনেকক্ষেত্রে হিসাবকৃত কারেন্টের সাথে একেবারে মিল রেখে বাজারে সার্কিট ব্রেকার নাও পাওয়া যেতে পারে, এক্ষেত্রে সবচেয়ে কাছের মানের যে সার্কিট ব্রেকার বাজারে পাওয়া যাবে তাই ব্যবহার করতে হবে।
- সার্কিট ব্রেকার লাগানো হয়ে গেলে অল্প সময়ের জন্য সার্কিট অন এবং অফ করে দেখতে হবে যে ইহা ঠিকমত কাজ করছে কি না।
- সবকিছু ঠিক থাকলে সার্কিট ব্রেকারকে নাম্বারি বা লেবেলিং করে দিতে হবে যাতে পরবর্তীতে কোন নির্দিষ্ট লোড বা সার্কিটের জন্য সংশ্লিষ্ট সার্কিট ব্রেকার সনাক্ত করতে সমস্যা না হয়।